আমার শিরায় জ্বলে আগুন,
রুদ্ধশ্বাসে পুড়তে চায়।
আমার চোখে ঝড়ো মিছিল,
শ্লোগানে বদ্ধ উপমায়।

মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৭

ইতিহাসের এক বর্বরতম ঘটনা একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড


ডিসেম্বর ১৯৭১। পাকিস্তানিরা বুঝে গেলো তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তাই তারা তাদের বাকি থাকা সবচেয়ে ভয়াবহ কাজটা সম্পন্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। হ্যা, সেটাই ছিলো বাঙলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যা। "বাকি থাকা কাজ" এ জন্যেই বলছি কারণ এদেশের নির্দিষ্ট কিছু বুদ্ধিজীবী হত্যা করার পরিকল্পনা পাকিস্তানিদের আগে থেকেই ছিলো। যুদ্ধে হেরে যাওয়ার আগে শেষ কামড় দিয়েছিলো পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে। 

বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক ছিলো পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে এ হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করেছিলো  তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস। কিন্তু কিভাবে এই হত্যাযজ্ঞটি শুরু হয়েছিল!! 

প্রথমে যে ব্যাপারটিতে নজর দেয়া যায় তা হলো, পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যা করা বুদ্ধিজীবীদের সবাইই ছিলো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাবের জন্য সুপরিচিত। আল বদর বাহিনীর কাছে সব অধ্যাপক বা সাংবাদিকই এক ছিলো কিন্তু যারা এই বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা করেছিলো তাদের টার্গেট ছিলো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বুদ্ধিজীবীরাই।

ব্যাপারটি নিশ্চিৎ হওয়া যায় বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক রাও ফরমান আলীর ডায়রি থেকে। সেখান থেকে জানা যায় সি আই এ এজেন্ট  হেইট ও ডুসপিকের কথা। সি আই এ বুদ্ধিজীবীদের এই তালিকা তৈরি করে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে। মুহাম্মদপুরের শারিরীক শিক্ষা কলেজটি ছিলো পাকিস্তানি ও মার্কিনী চক্রান্তকারীদের পরিকল্পনাস্থল। ১৪ ডিসেম্বর যেসব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় তাদের প্রথমেই নিয়ে যাওয়া হয় এই শারিরীক শিক্ষা কলেজে।

বাঙলাদেশ স্বাধীন হয় ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। এরপর এই গণহত্যার তদন্ত করতে গঠন করা হয় "গণহত্যা তদন্ত কমিটি" যার সভাপতি ছিলো জহির রায়হান, যিনি নিজেও ছিলেন একজন প্রচণ্ড সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। স্বাধীন বাঙলার প্রথম গুম হওয়া ব্যক্তি হচ্ছেন জহির রায়হান। জহির রায়হানের হত্যার জন্য তার স্ত্রী সুমিতা দেবী রফিক নামে একজনকে দায়ী করেন। কিন্তু জহির রায়হান যেদিন গুম হন তারপরেই সেই রফিক পরিবারসহ আমেরিকা চলে যায়। তাকে জহির রায়হানের গুমের ব্যাপারে যেকোনো জবাবদিহিতা থেকে আজীবন যুক্তরাষ্ট্র রক্ষা করেছে।

১৯৭১ সালে ঠিক কতজন বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিলো তার সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। সি আই এ এর তালিকায় নাম ছিলো প্রায় ৩০০০ জন বুদ্ধিজীবীর। বলা হয়ে থাকে পাকিস্তানিরা যদি আর এক সপ্তাহ পরে আত্মসমর্পন করতো তাহলে তারা এই তালিকার সবাইকেই হত্যা করে ফেলতো। বাংলাপিডিয়া থেকে জানতে পারি পাকিস্তানিরা মোট বুদ্ধিজীবী হত্যা করতে পেরেছিল ৯৯১ জন। যদিও বাস্তবে আরো অধিক হবে সংখ্যাটা তা বলাই বাহুল্য। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন,

শহীদুল্লাহ কায়সার
নিজামুদ্দীন আহমেদ
সেলিনা পারভীন
সিরাজুদ্দীন হোসেন
আ ন ম গোলাম মুস্তফা
আলতাফ মাহমুদ
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত 
রণদাপ্রসাদ সাহা 
যোগেশ চন্দ্র ঘোষ
জহির রায়হান
নূতন চন্দ্র সিংহ
Intellectual Killing in Bangladesh 

বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগেরই লাশ পাওয়া যায় নি। যাদের লাশ পাওয়া গেছে তার প্রায় সবগুলোই ছিলো নানা বদ্ধভূমিতে। মুক্তিযুদ্ধের এ পর্যন্ত ৯৯২ টি বদ্ধভূমি পাওয়া গেছে। তবে বুদ্ধিজীবীদের লাশগুলো পাওয়া যায় মুহাম্মদপুর, মিরপুর ও রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে। হত্যার আগে তাদেরকে ভয়ানকভাবে অত্যাচার করা হয়েছিলো। যন্ত্রণা দিতে দিতে একদম শে্ষ মুহুর্তে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিলো। বেশিরভাগকেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিলো কাউকে কাউকে গুলি করে মারা হয়েছিলো। তাদের লাশগুলো দেখেই অত্যাচারের নির্মমতা বুঝা গিয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটা লাশ খুঁজে পাওয়ার কথা জানা যায় যার বর্ণনা ছিল এরকম "আর একটু এগিয়ে যেতেই বাঁ হাতের যে মাটির ঢিপিটি ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা। পরনে কালো ঢাকাই শাড়ী ছিল। এক পায়ে মোজা ছিল। মুখ ও নাকের কোন আকৃতি নেই। কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। মেয়েটি ফর্সা এবং স্বাস্থ্যবতী। স্তনের একটা অংশ কাটা। লাশটা চিৎহয়ে পড়ে আছে। বিভৎস চেহারার দৃশ্য বেশীক্ষণ দেখা যায়না। পরে অবশ্য সনাক্ত হয়েছে যে, মেয়েটি সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। শিলালিপির এডিটর।



১৪ ডিসেম্বরকে বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করেন বাঙলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। যেহেতু ১৯৭১ এর ১৪ ই ডিসেম্বর সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিলো তাই ১৪ ডিসেম্বরকেই বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার রায়ের বাজারে নির্মিত হয়েছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। এর স্থপতি হচ্ছেন মোস্তফা হালি কুদ্দুস। 

একটা দেশের এগিয়ে যাবার জন্য দরকার বুদ্ধিজীবীদের, তারাইতো জাতির পথপ্রদর্শক। একাত্তরের আমরা তাদের একটা বিশাল অংশ হারিয়েছি।  আজ বাঙালি এই স্মৃতিসৌধে এসে একাত্তরে সেসব বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগের কথা স্মরণ করে। এরকম হাজারো বুদ্ধিজীবী আমাদের মাঝে জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করেছিলো বলেই আমরা একাত্তরে যুদ্ধ করতে পেরেছিলাম। প্রফেসরদের জ্ঞানে, সাংবাদিকের লেখায় আর শিল্পীর গানে বাঙালি জাগ্রত হয়েছিলো একাত্তরে। সেইসব বুদ্ধিজীবীরা শুরু করেছিলো এক নতুন অভ্যুদয়ের, এক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনার। যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই একাত্তরে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে বাঙালি। কিন্তু আমরা হারিয়ে ফেলি এদেশের সূর্যসন্তানদের। স্বাধীন বাঙলাদেশ তাদের ভুলে নাই। বুদ্ধিজীবী দিবসে সেইসব শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগের কথা প্রবল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বাঙালি।

মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৭

আদিবাসীদের নিয়ে কিছু প্রলাপ


আদিবাসী কি? খায় না মাথায় দেয়? 
কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় দখলদার জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বে যারা বসবাস করত এবং এখনও করে,যাদের নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি রয়েছে তারাই মূলত আদিবাসী। তবে আদিবাসী শব্দটার সংজ্ঞা নিয়ে বাঙলাদেশই না শুধু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রয়েছে যথেষ্ট বিতর্ক। যারা আদিবাসীদের উপজাতি করে রাখতে চায় আসলে তারাই চায়না দেশে আদিবাসী বলে স্বীকৃত কেউ থাকুক। বাঙলাদেশের সংবিধানের দিকে তাকালে তাই এই প্রশ্নই জাগে আদিবাসী খায় না মাথায় দেয়?

 বাঙলাদেশে আদিবাসী 
বাঙলাদেশ সরকারের মতে,বাঙলাদেশে কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠী নেই। তবে সরকার এর কথা আজকাল কেউ বিশ্বাস করে না তাই বলছি, বাংলাদেশে প্রায় ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু বুঝতেই পারছেন তাদের সাংবিধানিক কোনো স্বীকৃতি নেই।
আদিবাসী বলতে তাহলে কাদের বুঝাচ্ছি? তারা হচ্ছে, যারা এই মাটিতে সবার আগে এসেছে, চাষ করেছে এবং এই দুর্গম পাহাড়ি,শ্বাপদসংকুল পরিবেশে নিজেদের হাজার বছর টিকিয়ে রেখেছে। এইরকম জাতিদের মধ্যে রয়েছে, খিয়াং, খুমী, চাক, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা , সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, কোচ, রাজবংশী, মণিপুরি, খাসী, ত্রিপুরা, লুসাই, বরিশালের রাখাইন সহ অন্তত ৪৫ টা জাতি। তারাই এই দেশে প্রথম এসেছে, তারাই কি তাহলে আদিবাসী নয়? 


আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান
নির্যাতনের দিক থেকে এদেশের আদিবাসীদের উপর নির্যাতনের মাত্রা কোন অংশে কম ছিল না পাকিস্তান আমলে। বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে প্রচুর আদিবাসী নারী ও পুরুষ মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে রক্ত ঝরায় প্রত্যেকটা আদিবাসীগোষ্ঠীর মানুষই।
একাত্তরে পাকিস্তান সেনা বাহিনী সাঁওতালদের হিন্দু হিসেবে গুনতো। তাই পাকিস্তানিদের অত্যাচারে বাঙলাদেশ থেকে ভারতে বিতারিত হইয়েছিল অন্তত ৩০,০০০ সাঁওতাল। তারা ভারতে গিয়ে বসে থাকেনি। প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসেছে দেশে,যুদ্ধ করেছে দেশকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচাতে। সেইসব সাঁওতালদের নেতা ছিলেন তখন আদিবাসী সাঁওতাল নেতা সাগরাম মাঝি। সাগররাম মাঝির অনুপ্রেরণাতেই সাওতালরা দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন এই সাগরাম মাঝি। জাতীয় ৪ নেতার একজন কামরুজ্জামানের রাজনৈতিক সহকর্মীও ছিলেন তিনি।


ঐ সময়ে সাঁওতাল বিশ্বনাথ টুডু ছিলেন একজন প্লাটুন কমান্ডার। ফাদার লুকাশ মারান্ডি ছিলেন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক। তিনি সাঁওতালদের যুদ্ধে নানাভাবে সাহায্য করতো সেজন্য তাকে পাকিস্তানিরা হত্যা করে একসময়। যুদ্ধের সময় রাজশাহীর গোদাগাড়ির সাঁওতালরা ছিলো মুক্তিযুদ্ধাদের আশ্রয় ও খাদ্যদাতা। তাই পাকিস্তানিরা গোদাদাড়িতে হামলা চালায় এবং হত্যা করে প্রচুর সাঁওতাল। ধর্ষিত হয় প্রচুর সাঁওতাল নারী।
এরকম বীরত্বপূর্ন অবদান রয়েছে আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে। তাদের মধ্যে উল্লেখ্য কিছু যোদ্ধা হচ্ছেন, সাধন সিংহ, অনিতা সিনহা, বাণী সিনহা, নীলমনি চট্টোপাধ্যায়, নন্দেশ্বর সিংহ, বিজয় সিংহ, উ-মংয়াইন, উ-ক্যহ্রাচিং, উ-উসিতমং, রাজা মপ্রু, তাতিন্দ্রলাল চাকমা, রসময় চাকমা সহ অসংখ্যজন। 

 স্বাধীন বাঙলাদেশে আদিবাসীদের অবস্থা 
যে দেশে আদিবাসী বলতেই কিছু নেই সে দেশে আদিবাসীদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা সহজ না। বাঙলাদেশে আদিবাসীদের সংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষের মত। আদিবাসীদের একটা বিশাল অংশ পাহাড়ি। তারা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এই তিন জেলাতেই বসবাস করে বেশিরভাগ।
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু আদিবাসী নেতাদের বলেছিলেন,আমরা সবাই বাঙালি। তোমরা তোমাদের পরিচয় ভূলে যাও এবং বাঙালি হয়ে যাও। ১৯৭৩ এ তিনি রাঙ্গামাটিতে গিয়েও বলেন, তোরা সবাই বাঙ্গালি হইয়া যা। অথচ পাকিস্তানিরাও ঠিক একইভাবে আমরা বাঙালি বলে আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার নিকৃষ্টতম ব্যাবহার করেছিল এবং আমাদের উপরে একইভাবে তাদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলো। তাই আদিবাসীদের সাথেও ঠিক সেই কাজটাই করাটা ছিলো আমাদের আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক।

কিন্তু ১৯৭৯ এ জিয়াউর রহমান এই পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালি সেটেলার মুসলিমদের স্থানান্তরিত করে। এরপর থেকেই পাহাড়িদের জীবনে নেমে আসে আস্ত এক নরক। নিজ ভূমিতে পরবাসির মত বেঁচে আছে তারা। চরম খাদ্যের অভাব, বাঙ্গালী সেটেলারদের দ্বারা জোরপূর্বক ভূমি দখল,আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ, হত্যা, ও আদিবাসীদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগানো, তাদের উচ্ছেদ করা এখন সেখানকার নিত্যনৈমত্যিক ব্যাপার।


সমতলের আদিবাসীদের ও একই হাল। এইতো কদিন আগেই সাঁওতালদের উপরে অমানবিক হামলা ও ভূমি দখলের কথা আমাদের সবার মনে আছে। 


পাহাড়ে এসব আদিবাসীবিরোধী কর্মকাণ্ডের পিছনে সবসময়ই থাকে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ। সেনাবাহিনী পাহাড়ে বাঙালি সেটলারদের নিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ১৩ থেকে ১৫ টা গণহত্যা চালিয়েছে। আর আদিবাসীদের উপর অত্যাচারতো নিত্যনৈমত্যিক ব্যাপার। পার্বত্য তিন জেলাকে মিলিটারি ক্যাম্প বানিয়ে রাখা হয়েছে। কল্পনা চাকমার সাথে যা ঘটেছিল সেটা আজ পাহাড়ের নিয়মিত ঘটনা।

কিছু পরিসংখ্যান থেকে ধারণা নেয়া যাক...... 




পরিসংখ্যানগুলো মাত্র ৭ বছর সময়কালের মধ্যে করা। আর এসবতো শুধু পরিসংখ্যানই, বাস্তব আরো ভয়াবহ।

 এর শেষ কোথায়? 
আদিবাসীদের এই করুণ অবস্থার জন্য দায়ী মূলত তাদেরকে আদিবাসী স্বীকৃতি না দেয়া। জাতিসংঘ অধিবেশনে দাঁড়িয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপুমনী বলেছিলেন, বাঙলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনের ফার্ষ্ট সেক্রেটারী ইকবাল আহমেদ ও বলেছেন, বাঙলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। তিনি আরো বলেন, এদেশে আদিবাসী খুঁজে যেনো জাতিসংঘ সময় নষ্ট না করে। অথচ বর্তমান হাসিনা সরকার যখন ২০০৮ এ তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে তখন সেখানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়ার কথা উল্লেখ ছিলো। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর গণেশ উলটে গেলো! পরিসংখ্যান বলে কোনো সরকারের আমলেই আদিবাসীদের উপর অত্যাচার কম ছিলো না। পাকিস্তানির আমাদের সাথে যা করেছে আমাদের সেনাবাহিনী সেখানে যেনো তারই অনুকরণ করে চলেছে। একটা মানবিক বাঙলাদেশ গড়ার স্বপ্ন ততদিন সত্যি হবে না যতদিন না এই আদিবাসীদের উপর এই অমানবিকতা বন্ধ না হয়।
সংবিধানের ৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন। কথা হচ্ছে তাহলে সাগরাম মাঝিরা যুদ্ধ করেছিলো কি জন্য? তার থেকে বড় কথা এই ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী কি বাঙালি? তারা যদি চাকমা , মারমা বা গারো হয় তাহলে তারা কি বাঙলাদেশের নাগরিক না? আমরা কজন চাকমাদেরকে বাঙালি মনে করি? দেশটাকি তাহলে শুধু বাঙালিরই হলো! বাঙলাদেশ কি  এসব আদিবাসীগোষ্ঠীর না! আর আদিবাসী নির্যাতন বন্ধে আইন কি হবে না! সেনাবাহিনী কি আইনের ঊর্ধ্বে? আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে আমরা কবে সচেতন হব? তারা এভাবেই নির্যাতিত হয়ে যাবে আজীবন!  

শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৭

বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম


সেক্যুলারিজম কি?
সেক্যুলারিজম হচ্ছে এমন একটা মতবাদ বা নীতি যার দুটো দিক রয়েছে। এক দিক হচ্ছে, রাষ্ট্রকে যেকোনো ধরণের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এর প্রভাবমুক্ত রাখা। অন্যটি হচ্ছে, সব ধর্মের ও মতের মানুষ আইনের কাছে সমান বলে বিবেচিত হবে। সহজ কথায়, ধর্মের নামে কারো বিরুদ্ধে কোনো বৈষম্য নয়।

 


আরেকটু ভেঙ্গে বললে...


-রাষ্ট্রের সাথে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কহীনতাই হচ্ছে সেক্যুলারিজমের মুল নীতি। সেক্যুলারিজম নিশ্চিত করে কোনো ধর্মভিত্তিক দল বা গোষ্ঠী কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের কোনো ব্যাপারে নাক গলাবে না।

-একটা সেক্যুলার দেশে সব নাগরিক আইনের কাছে সমান।

-সেক্যুলারিজম সব ধর্মের আস্তিক এবং নাস্তিক উভয়কেই রক্ষা করে।

-সেক্যুলারিজম মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।

-সেক্যুলার দেশে আপনি যুক্তি দিয়ে যেকোনো ধর্মীয়,রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক মতবাদের সমালোচনা করার অধিকার রাখেন।

-সেক্যুলারিজম এর সাথে নাস্তিকতা, অজ্ঞেয়বাদ বা ঈশ্বরসম্পর্কিত আধুনিক মতবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এধরনের মানুষ একটা সেক্যুলার দেশেই বাস করতে পছন্দ করে কারণ সেক্যুলার রাষ্ট্র সবার অধিকার নিয়েই সমান সচেতন থাকে।
  
বাঙলাদেশে সেক্যুলারিজম

বাঙলাদেশের জন্মই হয়েছে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এক বিপ্লব থেকে। ১৯৪৭ এ বৃটিশরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশ ছেরে চলে যায় তখন তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে যায়। তখন পাকিস্তানের ছিলো দুইটা অংশ , পূর্ব পাকিস্তান(বর্তমান বাঙলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান। মজার ব্যাপার হচ্ছে পাকিস্তানের এই দুই অংশের মাঝে দূরত্ব ছিলো অন্তত ১২০০ কিলোমিটার। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী সংস্কৃতির চর্চা থাকায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের হিঁদুয়ানি মুসলিম বলতো এবং সংস্কৃতি,অর্থনীতিসহ সকল দিকে পূর্ব পাকিস্তানীদের দাবিয়ে রেখেছিলো। এরপর ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের একটা সেক্যুলার মোডারেট দল সমগ্র পাকিস্তানে জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা বাঙালীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে চায় না। উলটো তারা ১৯৭১ সালে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা শুরু করে। এসময় জামাত-ই-ইসলামি ও মুসলিম লীগ সহ সকল ইসলামপন্থী দলগুলো পাকিস্তানিদের এই গণহত্যায় সাহায্য করে। তাদের সহযোগিতায় পাকিস্তানীরা প্রায় ৩২ লক্ষ বাঙালি হত্যা করে ,সাথে ধর্ষণ করে অন্তত ৪ লক্ষ বাঙালি নারিকে। এরপর ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা পেয়েছিলাম মুক্তির স্বাদ। একাত্তরে আমরা রক্ত দিয়েছিলাম সেক্যুলারিজম এর জন্য।

১৯৭২ এর অরিজিনাল সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি। বঙ্গবন্ধু শেষদিকে সোশ্যালিস্ট বাঙলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। তাই তিনি বাকশাল(বাঙলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ) নামে একটা রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়ে বাঙলাদেশ ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। কিন্তু সেনাবিদ্রোহে তার মৃত্যু হয় ১৯৭৫ এর আগস্টে। এরপর জিয়ায়ুর রহমান সংবিধান থেকে সেক্যুলারিজম তুলে দেয় এবং সংযুক্ত করে "সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস"। আবার স্বৈরশাসক এরশাদ ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে। এসবের মাধ্যমেই বাঙলাদেশ ধর্মীয় সংঘাত ও সাম্প্রদায়িকতার দীর্ঘ রাস্তায় যাত্রা শুরু করেছিলো।

সংবিধান থেকে সেক্যুলারিজম তুলে দেয়া ছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সাথেও ছিলো ব্যাপারটা সাংঘর্ষিক। ২০১০ সালে যদিও আদালত সেক্যুলারিজম সংবিধানে ফিরিয়ে এনেছে তথাপি বাঙলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম এখনো ইসলামই রয়ে গেছে। রাষ্ট্রধর্মসহীত একটা সেক্যুলার দেশ চিন্তা করা খুব একটা সহজ ব্যাপার না।

বাঙলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থান

বাঙলাদেশের প্রথম ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থান হয় জঙ্গি সংগঠন হুজির মাধ্যমে। আফগান যুদ্ধে একসময় এ দেশ থেকে অনেক মুজাহিদ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে আফগানিস্তান গমন করেছিলো। তারাই দেশে ফিরে ১৯৯২ সালে হুজি প্রতিষ্ঠা করে। তারা ওসামা বিন লাদেন ও সৌদি আরব কর্তৃক সরাসরি অর্থ পেত। বাঙলাদেশ ও ভারতে একাধিক হামলার পিছনে রয়েছে হুজি।

বিশ্ব প্রথম এদেশে উগ্র ইসলামপন্থীদের উপস্থিতি টের পায় যখন নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে হত্যার জন্য ইসলামপন্থীরা ৫০০০ ডলার পুরস্কার ঘোষনা করে। এরপর ১৯৯৯ সালে উদীচীর একটা কনফারেন্সে ২ টা বোমা হামলা হয় এবং অন্তত ১০ জন নিহত হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার মধ্যে উল্লেখ্য ২০০৫ সালে জে এম বির সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলা। তারা এক ঘন্টার ও কম সময়ে সমগ্র বাঙলাদেশে ৬৩ জেলায় ৪৫০ এর ও অধিক বোমা বিস্ফোরিত করে। ২০১৪ সালে বেশ কয়েকটা জঙ্গি সংগঠন "জিহাদ কাউন্সিল" গঠন করে আসাম, বাঙলাদেশ ও রাখাইন অঞ্চল নিয়ে ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তারা মাদ্রাসা ছাত্র ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের থেকে যোদ্ধাও সংগ্রহ করছে।

ব্লগার হত্যা

ইসলামপন্থীদের বেঁধে দেয়া এক অদৃশ্য লাইন ক্রসের চেষ্টা যারাই করেছে তাদের জন্য বাঙলাদেশ দিন দিন বিপদজনক হয়ে উঠছে। গত ২ বছরে অন্তত ১১ জন মুক্তমনা, সেক্যুলারিস্ট ব্লগার, লেখক নিহত হয়েছে তাদের হাতে।

সেক্যুলার শাহবাগ আন্দোলন চলার সময়ে ২০১৩ সালে ব্লগার রাজিব হায়দার মিরপুরে জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। এরপর ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার অভিজিত রায় ও তার স্ত্রী বন্যা আহমেদ জঙ্গিদের দ্বারা আক্রমণণের স্বীকার হন। প্রতিভাবান লেখক অভিজিৎ রায় নিহত ও বন্যা আহমেদ মারাত্মক আহত হন। ঐ বছরের মার্চেই ২ জিহাদির হাতে নিহত হয় ওয়াশিকুর বাবু। 'যুক্তি'র সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাস জিহাদিদের আক্রমণে নিহত হন ২০১৫ এর মে মাসে। ব্লগার নীলকে হত্যা করা হয় ২০১৫ এর আগস্ট মাসে। এরপর এরকম আরো অসংখ্য মৌলবাদী হামলার স্বীকার হয় বাঙলাদেশ যার সর্বশেষ হচ্ছে গুলশান এটাক।


                                         


এসব হামলার পরে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদউজ্জামান খান উল্টো ব্লগার ,লেখকদের দোষ দিয়ে বলেছেন ধর্মীয় নেতাদের সমালোচনা করার অধিকার কারো নেই এবং নিহত ব্লগারদের লেখা তদন্তের কথাও জানান তিনি। নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবী করা একটা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনি এরকম ভয়ংকর বক্তব্য আশা করতে পারেন না। বাঙলাদেশ মুক্তমনা লেখক,ব্লগারদের জন্য দিন দিন বিপদজনক হয়ে উঠছে। হামলা গুলোর প্যাটার্ন প্রায় একইরকম। তবে সবচেয়ে কষ্টদায়ক হচ্ছে হামলার পরে সরকারের এরকম নিকৃষ্ট বক্তব্য। যার ফলে গত কয়েক বছরে বাঙলাদেশে একের পর এক প্রগতিশীলদের উপরে হামলার ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে।

আমাদের করণীয়

এদেশের সরকার সবসময়েই মৌলবাদীদের সাথে আপোষ করেছে। বাঙলাদেশে মৌলবাদের উত্থানের জন্য আওয়ামী লীগ সহ সব প্রধান রাজনৈতিক দল ই দায়ী। বর্তমান সরকার শাহবাগে হামলা করে বলেছে ব্লগারেরা জাতিকে বিভক্ত করছে। পাশাপাশি তারা হেফাজাতকে ডোনেট করছে, তাদের সকল অন্যায় দাবী মেনে নিচ্ছে। কে এই হেফাজাত এ ইসলাম! একটা উগ্র ধর্মান্ধ দল যারা কিনা পুরো পৃথিবীর কাছে বাঙলাদেশকে একটি মধ্যযযুগীয় ধর্মান্ধ দেশ হিসেবে পরিচিত করিয়ে দিতে চায়।

তাই আমাদেরকে এখুনি রুখে দাঁড়াতে হবে লাখ শহীদের রক্তের মুূল্য দিতে। মুক্তমনা লেখকেরা কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে না, তারা শুধু একটা সুন্দর বাঙলাদেশ গড়তে চায়। আমাদেরকে সংগ্রাম করতে হবে হিন্দু মুসলিম পাশাপাশি অবস্থানের জন্য। আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্বাস যার যার, বাঙলাদেশ সবার।



সরকারের এখন দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যেসব ব্যাপারে সুপারিশ করতে চাই তা হল..

১/ দেশে জঙ্গি নেই সরকারের এরকম বক্তব্য দেয়া বন্ধ করতে হবে। সমস্যাটা মেনে নিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা প্রয়োজন। নিজে নিজে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবো এরকমটা ভাবা বোকামি ছাড়া কিছুই না।

২/মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে সেক্যুলার সাব্জেক্টগুলো পড়াতে হবে। তারা যেনো সব ধর্মের, মতের মানুষের ব্যাপারে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে বড় হতে পারে সে সুযোগ করে দিতে হবে।

৩/মাদ্রাসা ছাত্রদের জন্য যথেষ্ট চাকরি ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে।

৪/ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করতে হবে। ১৯৭১ এ দেশ স্বাধীনের পরে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিলো। সেখানে নিয়ে যেতে হবে দেশকে।


সর্বশেষে বলতে চাই, এখন বাঙলাদেশের ভবিষ্যৎ বেছে নেয়ার সময়। আমরা কি পাকিস্তানের মত একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র চাই নাকি প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ বাঙলাদেশ চাই। সময় চলে যাচ্ছে , আপনাকে আমাকে সবাইকে এখুনি আওয়াজ তুলতে হবে।



                                                                            আমার মাটি, আমার মা
                                                                               পাকিস্তান হবে না।
                                                                                    জয় বাঙলা।





মঙ্গলবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৭

ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্টদের উপরে চালানো ভয়ংকরতম গণহত্যা


১৯৬৫ সাল,ইন্দোনেশিয়া। 
১ অক্টোবর একদম সকালে সামরিক বাহিনীর জুনিয়র কিছু অফিসার ছয়জন জেনারেলকে হত্যা করে এবং রাজধানী জাকার্তার নিয়ন্ত্রণ নেয়। মেজর জেনারেল সুহার্তো তখন সশস্ত্রবাহিনীর কমান্ড গ্রহণ করেওইদিনই  জেনারেল সুহার্তোর পরিচালনাধীন সেনাবাহিনী বিদ্রোহী অফিসারদের নির্মূল করে ফেলে। কিন্তু একই সাথে তিনি এই সেনা অভ্যুত্থানকে কমিউনিস্টদের চক্রান্ত বলে দায় কমিউনিস্টদের উপরে চাপিয়ে দেয়।


জেনারেল সুহার্তো

এরপর যা হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সহজ নয়। লিস্ট করে কমিউনিস্ট হত্যা করা শুরু হয়। এই লিস্ট ইন্দোনেশিয়ান সেনাবাহিনীর হাতে দিয়েছিল মূলত সি আই এ। সি আই এ ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিতে তাদের অসংখ্য এজেন্ট আগেই ঢুকিয়ে রেখেছিলো। এতে করে লিস্ট তৈরি করতে তাদের খুব বেগ পেতে হয় নি। এরপর কৃত্রিম সেনা অভ্যুত্থানের দায় চাপিয়ে দিয়ে শুরু হয় সেই লিস্ট ধরে ধরে কমিউনিস্ট হত্যা ।

 এই হত্যাকাণ্ডে আরো অংশ নিয়েছিলো কমিউনিস্ট বিরোধী মুসলিমরা। সন্দেহভাজন কমিউনিস্টদের ও তারা ছেরে দেয় নি। ধর্মের কথা বলে সাথে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার করে তাদেরকে সহজেই হত্যাকাণ্ডে যুক্ত করা গিয়েছিলো। যদিও কমিউনিস্ট বিরোধী সেসব প্রোপাাগান্ডা সেনাবাহিনী কখনই প্রমাণ করতে পারে নি।

ইন্দোনেশিয়ায় কমিউনিস্টরা ছিলো চীন ও সোভিয়েত বলয়ের বাইরে সবচেয়ে শক্তিশালী কমিউনিস্ট দল। তাই সাম্রাজ্যবাদীরা বুঝে গিয়েছিল সুকর্ণ ( ইন্দোনেশিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান ) এর পতনের পরে শক্তিশালী কমিউনিস্টরাই ইন্দোনেশিয়ায় ক্ষমতায় আসবে। এর আগেও সুকর্ণ কমিউনিস্টদের সাথে একরকম ক্ষমতা ভাগাভাগি করেই রেখেছিল। তাই তারা কমিউনিস্টদের ইন্দোনেশিয়া থেকে একদম মুছে ফেলতে চেয়েছিলো।

ইন্দোনেশিয়ান কমিউনিস্টদের হত্যার জন্যে আমেরিকা সুহার্তোর সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ সাহায্য করেছিল। এটা ছিলো ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর গণহত্যা। কমপক্ষে ১০ লক্ষ কমিউনিস্ট হত্যা করা হয়েছিল তখন। এই বৃহৎ গণহত্যা চালাতে গিয়ে সেনাবাহিনী খাদ্য ও গোলাবারুদ সংকটের মুখোমুখি হয়। আমেরিকা তাদেরকে এসব দিকে সর্বোচ্চ সাপ্লাই দিয়ে গণহত্যা অব্যাহত রাখে। সেনাবাহিনী যদি তখন এই সাপ্লাই না পেত তাহলেও তারা টিকতে পারতো না।


গণহত্যা এত প্রকট রূপ ধারণ করেছিল যে ইন্দোনেশিয়ার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সর্বত্র লাশের গন্ধ পাওয়া যেত। মাছেরা লাশ খাচ্ছে এই জন্য দীর্ঘদিন মানুষ মাছ খাওয়া বর্জন করেছিল। এই দশ লক্ষ কমিউনিস্ট হত্যার মাধ্যমে আমেরিকা এশিয়ায় তার চূড়ান্ত প্রভাব দেখালো। গণহত্যায় আমেরিকা যদি সম্পৃক্ত না থাকতো তাহলে বিশ্ববাসীকে এখন ভিন্ন এক এশিয়া দেখতে হতো।




আজকে সেই ইন্দোনেশিয়ার কি অবস্থা! ১৯৬৫ তে জেনারেল সুহার্তো আমেরিকার সহায়তায় ক্ষমতা দখলের পর থেকে সবসময় আমেরিকার সহায়তা পেয়ে গেছে। দেশটাকে একটা সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো আইনের ঊর্ধ্বে। ১৯৯৮ তে সেনাবাহিনীর পতন ঘটার পরেও তারা এখনো বিচার বিভাগের ঊর্ধ্বেই রয়ে গেছে। সুহার্তোর কারনে পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশিয়ার অধিগ্রহণ ও হস্তক্ষেপের ফলে প্রায় এক লক্ষ লোকের মৃত্যু ঘটে। এখনো তাদের বিনাবিচারে হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয় না। সন্ত্রাসবাদের প্রতি তাদের সমর্থন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে ছোটো ছোটো বাচ্চাদের ও পড়ানো হয় ১৯৬৫ এর সেই গণহত্যা ছিলো বীরত্বপূর্ণ কাজ।


সুহার্তোকে বলা হয় আধুনিক সময়ের সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ ও হিংস্র রাষ্ট্রনেতা। তার সমাজতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড দেশকে একসময় স্থবরতার দিকে নিয়ে যায়। এখনো সেখানে বাকস্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। তবে, এমেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ৫০ বছর পরে এই রোমহর্ষক গণহত্যার বিচার দাবী করেছে। যতদূর জানা যায় নানা প্রতিকূলতার পরেও এখন এই গণহত্যার বিচারে সমান্য অগ্রগতি হয়েছে । 

সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৭

আবার [ সায়েন্স ফিকশন ]


    


মহাকাশযানের বিশাল মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে রাফা।সে এই মাত্র যে মহাকাশযানটি ধ্বংস করেছে সেটি তাদের মার্স ফাইটারদেরই, যদিও তার উদ্দেশ্য ছিলো একটা শত্রু মহাকাশযান। এমনিতেই মঙ্গলের বিদ্রোহীদের মধ্যে মহাকাশযান ও প্রশিক্ষিত যোদ্ধার অভাব বিদ্যমান। এরকম সামান্য কিছু স্কাউটশিপ, যুদ্ধযান নিয়েই তারা পৃথিবীর মানুষদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করে এসেছে।তারমধ্যে এরকম আত্মঘাতী আক্রমনের জন্য তার কি শাস্তি হতে পারে তা রাফা অনুমান করতে পারছে।কিন্তু এই মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাওয়া যুদ্ধযানটির যোদ্ধাদের জন্য শোকে তার সব অনুভুতিগুলো অবশ হয়ে যাচ্ছে। একসাথে যাদের সাথে যুদ্ধ শিখেছে, ছোটো থেকে একসাথে যাদের সাথে মঙ্গলের সীমিত সম্পদ ভাগাভাগি করে ভোগ করেছে তাদের কাউকে হত্যা করার মনকষ্ট তার সমগ্র চেতনা গ্রাস করে ফেললো।
অনেকদিন আগের কথা।পৃথিবীতে পঞ্চম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি স্বরূপ মঙ্গলগ্রহে নির্বাসন দেয়া হয়।তাদের জন্য সামান্য সম্পদ দেয়া হয়েছিলো। মঙ্গলকে তখনো মানুষের বসবাসের পুরোপুরি উপযোগী করে তোলা হয় নি।সেইসব মানুষেরা তখন মঙ্গলের বনভূমির পরিমান বাড়ালো, প্রযুক্তির উন্নয়ন করলো। এরপর অনেকগুলো প্রজন্ম পেরিয়ে ২৫ শতকের শেষে এসে তাদের সভ্যতা বেশ উন্নত হয়ে উঠলো।কিন্তু পৃথিবীর মানুষেরা তাদেরকে কখনো ভালো থাকতে দেয় নি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা মঙ্গলের সীমিত সম্পদ জোর করে নিজেদের করে নিচ্ছিলো।তার প্রতিবাদ করতেই আজ তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে।পঞ্চম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর সব দেশ এখন একটা দেশে পরিনত হয়েছে।তাদের সবার এখন একটাই আতংক এই মার্চ ফাইটার রা।এখন তারা শুধু নিজেদেরকে পৃথিবীবাসির শোষণ থেকেই রক্ষা করে না মাঝে মধ্যে পৃথিবীতেও আক্রমন করে।তাদের সাহস আর শৃঙ্খলা তাদেরকে ভয়ংকর করে তুলেছে।
মনিটর থেকে চোখ নামালো রাফা।শত্রু মহাকাশযান গুলো পৃথিবীতে ফিরে গেছে।মহাকাশযানের অভাবে তারা ওদের পিছনে ধাওয়া করতে পারে নি।কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে ছোটো হলরুমের মধ্যে এসে দাড়ালো সে।মঙ্গলীয় যোদ্ধাদের রবোট ছিলো তাদের জন্য অপ্রতুল আর রাফা খুব আত্মবিশ্বাসী ছিলো বলে সে তাকে সহায়তার জন্য কোনো রবোট বা সহকারী নেয় নি। তাদের যোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই মনে করে তাদের নেতা হেটফিল্ডের পরেই রাফা সবচেয়ে ভয়ংকর মঙ্গল সেনা। কিন্তু আজকের ঘটনার পরে তাকে কি শাস্তি দেয়া হবে সে বুঝতে পারছে না।
তীক্ষ্ণ সাইরেনের মত করে এলার্ম বাজছে। রাফা সম্বিত ফিরে পেয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকালো।নিকটস্থ ফোবস মহাকাশকেন্দ্র থেকে তাদের নেতা হেটফিল্ড তার সাথে যোগাযোগ করার চেস্টা করছে।রাফা যোগাযোগ স্থাপন করতেই সামনে হেটফিল্ডের হলোগ্রাফিক ছবি ভেসে উঠলো....
- ক্যামন আছো রাফা?
- ভালো নেই,দোষটা আমারই ছিলো
- হা হা। ভয় পাচ্ছো নাকি অনুশোচনাবোধ?
- ভয় যে করছে না তা না। কিন্তু নিজের কাজের জন্য খারাপ লাগছে।
- শুধুই খারাপ লাগছে! তুমি জানো তুমি কি করেছো? সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার মত অপরাধ করেছো।
- আমি মঙ্গলের আইনকে শ্রদ্ধা করি। আমার শাস্তি আমি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত।
- তুমি আমাদের সবচেয়ে বিচক্ষণ যোদ্ধাদের একজন।তোমার কাছ থেকে এরকম কিছু আশা করি নি।
- ( মুখে সামান্য হাসি ফুটিয়ে তুললো রাফা)
-আমাদের অনেক সাফল্যে তোমার অবদান আছে। কিন্তু এটা তোমাকে শাস্তি থেকে বাঁচাতে পারবে না। আমাদের আইন - শৃঙ্খলা, নিয়ম কানুন পৃথিবীর মত সহজ নয়।
- (আবার ও ছোটো করে হাসি ফুটিয়ে তোলে রাফা)
- আমাদের প্রচলিত মৃত্যুদণ্ড খুব কষ্টেরসাথে দেয়া হয় জানো নিশ্চয়। কিন্তু তোমাকে একটা ছার দেয়া যাক। বেছে নাও কিভাবে মারা যেতে চাও!
- মাথায় গুলি করে মারার মত আদিম পদ্ধতি ই আমার পছন্দ।
- ঠিকাছে।তোমাকে আর ১২ ঘন্টা সময় দেয়া হলো। এর মধ্যে পালিয়ে যাওয়ার চেস্টা করে দেখতে পারো। যদিও সেটা অসম্ভব। হা হা..
-আমি সেটা জানি।আমি কখনো এমন ভুল করবো না হেটফিল্ড।
- বিদায় ....
সামনে থেকে হেটফিল্ডের হলোগ্রাফিক ছবিটি চলে গিয়ে দেয়ালটা দৃশ্যমান হলো। রাফা জানে এখন তার মৃত্যু আটকানোর সাধ্য কারো নেই।সে পৃথিবীতে যেতে পারবে না। মহাকাশেও বেচে থাকতে পারবে না। তখন তার মৃত্যু হবে আরো ভয়ংকর। রাফা মৃত্যু নিয়ে ভয় পাচ্ছে না। তাদের মত যোদ্ধাদের সেই ভয় থাকতেও হয় না।কিন্তু সে ত্রিসাকে নিয়ে ভাবছে। সে যখন থাকবে না তখন ত্রিসা কিভাবে একা থাকবে!
=======================
ত্রিসা তার জেটটি মহাকাশযানের ডেকে রেখে ভিতরে প্রবেশ করলো। কন্ট্রোলরুমে রাফা তার জন্য অপেক্ষা করছে।
- ক্যামন আছো ত্রিসা?
- ভালো নেই। লাইয়ুন তার যুদ্ধযানসহ ধ্বংস হয়ে গেছে।জানো নিশ্চয়!
- হু। আমিই করেছিলাম ওটা...
- কি! তুমি করেছিলে!! কিভাবে? তুমি সত্যিই এটা করেছো রাফা?
- দুর্ঘটনা বশত হয়েছে। আমার কিছুই করার ছিলো না।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ত্রিসা। তার চোখে পানি ছলছল করতে থাকে। "তুমি জানো তোমার মৃত্যুদণ্ড হতে পারে এখন! "
ত্রিসার দিকে তাকিয়ে রাফা উত্তর দিলো" হ্যা জানি। এবং সেটা আর ১০ ঘন্টার মধ্যেই দেয়া হবে। তোমার সাথে আমার এটাই শেষ দেখা"
ত্রিসা বসে পরলো কন্ট্রোল প্যানেলের উপরে "কি বলছো তুমি! "
"যা বলছি সব সত্যি।কিভাবে বলা উচিত ছিলো আমি জানি না।হেটফিল্ড আমার সাথে যোগাযোগ করে আমাকে আমার শাস্তি জানিয়েছে।ইতিমধ্যে হয়ত কাউকে আমাকে হত্যার জন্য পাঠিয়েও দিয়েছে।"
একটা ঠান্ডা ক্রুসনার মিনিমিসাইল এসে যেনো বিধলো ত্রিসার বুকে। "রাফা আমি তোমাকে ছারা কিভাবে থাকবো!"
"জানি না আমি।কিন্তু তোমার আর কিছু করার নেই"অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দিলো রাফা।
"না আছে।তুমি আমাকে লক করে দাও।তোমার সাথে আমিও মরে যাবো।প্লিজ...." কাঁদতে কাঁদতে অনুরোধ করলো ত্রিসা।
"উহু, মোটেও এমন কিছু আমি করবো না। আমাকে ভুলতে না পারলে তুমি মঙ্গলে ফিরে আমার স্মৃতিগুলো নষ্ট করে দিও।"
রাফার ঘারে হাত রেখে ত্রিসা বললো, আমি এটা করবো না। তুমি না চাইলেও আমি লক করে নিচ্ছি। তুমি নিশ্চয় চাইবেনা আমি অনেক কষ্ট নিয়ে বেচে থাকি!
"তাই বলেছিলাম মঙ্গলে ফিরে আমার স্মৃতিগুলো মুছে ফেলো তোমার মস্তিষ্ক থেকে।আমার শেষ ইচ্ছে টুকু সত্যি করবে না তুমি? আমি তোমাকে আমার সাথে মরতে দিতে পারি না" কাঁপা গলায় বললো রাফা।
রাফার অনুরোধে হার মানে ত্রিসা...
"ঠিকাছে আমি মঙ্গলে ফিরে যাবো। কিন্তু তোমার স্মৃতি নিয়েই বেচে থাকবো। যত কষ্টই হোক আমি তোমাকে ভুলতে চাই না। হেটফিল্ডের দন্ডাদেষ আটকানোর কোনো রাস্তা নেই। থাকলে আমি জীবন দিয়ে হলেও সেটা করতাম।" বলে রাফাকে জরিয়ে ধরলো ত্রিসা।
"আমি জানি ত্রিসা। কিন্তু তোমার এখন এখানে থাকা ঠিক হবে না। তুমি তোমার মহাকাশযানে ফিরে যাও। তাছারা তুমি নিশ্চয় তোমার সামনে আমাকে মরতে দেখতে চাও না! "
ত্রিসা কোনো কথা না বলে উঠে দাড়ালো। রাফার গালে আলতো করে হাত ছুঁয়ে ডেকের দিকে আগাতে লাগলো।
"ত্রিশা" পিছন থেকে ডাকলো রাফা। ত্রিশা ঘুরে দাড়ালো। তার চোখ বেয়ে অঝোরে পানি পরছে।
নিজেকে সামলে নিতে নিতে রাফা বললো "আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। ত্রিসা, ভালো থেকো তুমি ।বিদায়........"
দ্রুত ঘুরে ডেকে চলে এলো ত্রিসা। রাফার সামনে দাড়িয়ে থাকতে পারছিলো না সে। যাকে সেই ছোটোবেলা থেকে ভালোবেসে এসেছে তার মৃত্যু ত্রিসা কিভাবে সৈহ্য করবে সে জানে না।
====================
রাফা তার কক্ষে শুয়ে আছে। ত্রিসাকে নিয়ে তার কত স্বপ্ন ছিলো। এলিয়েঞ্জ লেকের কাছে তারা বাসা বাঁধবে।লেকের কৃত্রিম স্বচ্ছ পানিতে সাঁতরাবে। দূরের পাহাড়ে বেরাতে যাবে।কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে দুজন গল্প করবে।কিন্তু সব কিছুর শেষ হতে চলেছে। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে জড় বস্তুতে পরিনত হতে যাচ্ছে। তার সাথে সাথে কি তার স্বপ্নগুলোও ধ্বংস হয়ে যাবে! না যাবে না। রাফা জানে ত্রিসা সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবে। ভাবতে ভাবতে তার চোখ ছলছল করে ওঠে।কখনো সে কাঁদেনি, আজ ও কাঁদবে না। কিন্তু তার চোখদুটো যেনো কোনো বাধা মানছে না...
রাফা তার শেষ সময়ে ত্রিসার উদ্দেশ্যে কিছু শেষ কথা লিখলো। নিজের মৃত্যুটাকে খুব সাধারণ করতে চাচ্ছে রাফা।তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনেক আবেগময় একটা নোট সেন্ড করলো ত্রিসার কাছে। এরপর ত্রিসার কি হবে রাফা জানে না। সে তার যুদ্ধযান থেকে সব রকম যোগাযোগব্যাবস্থা বন্ধ করে দিলো।আর কখনো কারো সাথে তার যোগাযোগ হবে না।
রাফা চেয়েছিলো পৃথিবীবাসির সাথে যুদ্ধ না করে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে ব্যাপারটা শেষ করতে। পৃথিবীবাসিও হয়ত এখন সেটা মেনে নিতো কিন্তু হেটফিল্ড সেটা কখনো হতে দেয় নি। তারপর অনেক যুদ্ধ হয়েছে অনেক প্রান নষ্ট হয়েছে। এই যুদ্ধ শেষ হওয়ার নয়।রাফা মঙ্গলকে রক্ষার জন্য তার সব উৎসর্গ করতে পারে। এইসব ফাইটারদের সে অনেক ভালোবেসেছিলো। এখন মৃত্যুর আগে তাদেরকে ছেরে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। কিন্তু কিছুই করার নেই।
একটা জেট এসে থামলো। ডেক থেকে মহাকাশযানে প্রবেশের গেট রাফা খুলে দিলো। জেট থেকে ক্রাউস আর লুভেন নেমে এলো। এরা হেডফিল্ড এর বিশ্বস্ত, রাফা এদেরকে চেনে। রাফা হাতের ঘড়িতে দেখলো আর মাত্র দুইশ পঞ্চাশ সেকেন্ড বাকি আছে তার মৃত্যুর। রাফা হলরুমে বসে আছে। সে প্রস্তুত, অনুভুতিগুলো সব অকেজো হয়ে গেছে যেনো।
ক্রাউস আর লুভেন দ্রুত হলরুমে প্রবেশ করে রাফার সামনে দাড়ালো। "আমরা কখনো ভাবি নি এটা হবে " কাপা গলায় বললো ক্রাউস।
ক্রাউসের ঘারে হাত রাখতে রাখতে রাফা বললো"কেউ ই ভাবে নি।কিন্তু আমাদের মেনে নিতে হবে এটা। তোমরা যে জন্যে এসেছো সেটা করো। "
"তুমি গত কিছু ঘন্টাধরে যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছো। আমরা অনেক চেস্টা করেছি তোমার সাথে যোগাযোগের। না পেরে শেষে এখন তোমার কাছে আসলাম" ভরসাহীন কন্ঠে লুভেন বললো।
রাফা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো"কি হয়েছে লুভেন? "
"পৃথিবী থেকে আসা যুদ্ধযানগুলো আমাদের রাডার ফাকি দিয়ে ফোবস মহাকাশকেন্দ্রে আক্রমন করেছে।"
বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে নিলো রাফা "মানে! কখন? "
" কিছুক্ষন আগেই। আমরা ভেবেছিলাম ওরা পৃথিবীতে চলে গেছে। তাই কোনো প্রস্তুতিও ছিলো না ওদের থামানোর।"
"হেটফিল্ড! সে কিছু করতে পারেজ নি? "
"ওই মহাকাশকেন্দ্রের কেউ ই বেচে নেই। হেটফিল্ড ও না। আমরা এখন কি করবো বুঝতে পারছি না। তাই তোমার কাছে এসেছি। "
"আমার কাছে ক্যানো? " অবাক হলো রাফা।
"তুমি ছারা এখন আমাদের নেতৃত্ব দেয়ার আর কেউ নেই।এখন থেকে তুমিই আমাদের নেতা। মঙ্গলের সবাইই এটা মানবে।"
পিছন থেকে ত্রাউস এসে বললো "আমরা এখন কি করবো নেতা? "
রাফা একটু সময় নিলো" কিছু না। সবাই মঙ্গলে ফিরে যাবো এখন। সেখানে গিয়ে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করবো আমরা।যুদ্ধ আমি থামাবো"
ক্রাউস আর লুভেন এর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।তারা পুরো মঙ্গলে খবর পাঠিয়ে দেয় রাফা তাদের নেতা হতে রাজি হয়েছে।পুরো মঙ্গলে নেমে আশা শোক এই খবরে কাটতে শুরু করেছে।রাফা হঠাৎ করে আবিষ্কার করলো তার মধ্যেকার ভয়টা এখনো কাটেনি। কাটবেই বা কি কিভাবে! সামনে যে তার অনেক বড় কাজ বাকি রয়ে গেছে।
ক্রাউস আর লুভেন চলে যাওয়ার সাথে সাথেই আরেকটি জেট এসে থামলো।ত্রিসা নেমে এলো ভেতর থেকে।
কন্ট্রোলরুম...
"মহামান্য রাফা! কি করছেন আপনি?" হাসি আটকাতে আটকাতে বললো ত্রিসা।
"ত্রিসা! মহামান্য বলছো ক্যানো! " অভিমানের সুরে অভিযোগ করে রাফা।
"আমাদের নতুন নেতাকে মহামান্য বলবো না! " রাফার উপরে ঝাঁপিয়ে পরতে পরতে বললো ত্রিসা।
"ওই। ছাড়ো.... আগে মঙ্গলে ফিরে নেই তারপর" ঠোট বাকিয়ে হাসি ফুটিয়ে বললো রাফা।
"আচ্ছা। কিন্তু একটুখানি তো....... .................. " লজ্জায় বলতে পারলো না ত্রিসা। 3:)