আমার শিরায় জ্বলে আগুন,
রুদ্ধশ্বাসে পুড়তে চায়।
আমার চোখে ঝড়ো মিছিল,
শ্লোগানে বদ্ধ উপমায়।

শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৭

বাংলাদেশে সেক্যুলারিজম


সেক্যুলারিজম কি?
সেক্যুলারিজম হচ্ছে এমন একটা মতবাদ বা নীতি যার দুটো দিক রয়েছে। এক দিক হচ্ছে, রাষ্ট্রকে যেকোনো ধরণের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এর প্রভাবমুক্ত রাখা। অন্যটি হচ্ছে, সব ধর্মের ও মতের মানুষ আইনের কাছে সমান বলে বিবেচিত হবে। সহজ কথায়, ধর্মের নামে কারো বিরুদ্ধে কোনো বৈষম্য নয়।

 


আরেকটু ভেঙ্গে বললে...


-রাষ্ট্রের সাথে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কহীনতাই হচ্ছে সেক্যুলারিজমের মুল নীতি। সেক্যুলারিজম নিশ্চিত করে কোনো ধর্মভিত্তিক দল বা গোষ্ঠী কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের কোনো ব্যাপারে নাক গলাবে না।

-একটা সেক্যুলার দেশে সব নাগরিক আইনের কাছে সমান।

-সেক্যুলারিজম সব ধর্মের আস্তিক এবং নাস্তিক উভয়কেই রক্ষা করে।

-সেক্যুলারিজম মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।

-সেক্যুলার দেশে আপনি যুক্তি দিয়ে যেকোনো ধর্মীয়,রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক মতবাদের সমালোচনা করার অধিকার রাখেন।

-সেক্যুলারিজম এর সাথে নাস্তিকতা, অজ্ঞেয়বাদ বা ঈশ্বরসম্পর্কিত আধুনিক মতবাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এধরনের মানুষ একটা সেক্যুলার দেশেই বাস করতে পছন্দ করে কারণ সেক্যুলার রাষ্ট্র সবার অধিকার নিয়েই সমান সচেতন থাকে।
  
বাঙলাদেশে সেক্যুলারিজম

বাঙলাদেশের জন্মই হয়েছে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এক বিপ্লব থেকে। ১৯৪৭ এ বৃটিশরা যখন ভারতীয় উপমহাদেশ ছেরে চলে যায় তখন তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে যায়। তখন পাকিস্তানের ছিলো দুইটা অংশ , পূর্ব পাকিস্তান(বর্তমান বাঙলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তান। মজার ব্যাপার হচ্ছে পাকিস্তানের এই দুই অংশের মাঝে দূরত্ব ছিলো অন্তত ১২০০ কিলোমিটার। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালী সংস্কৃতির চর্চা থাকায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের হিঁদুয়ানি মুসলিম বলতো এবং সংস্কৃতি,অর্থনীতিসহ সকল দিকে পূর্ব পাকিস্তানীদের দাবিয়ে রেখেছিলো। এরপর ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের একটা সেক্যুলার মোডারেট দল সমগ্র পাকিস্তানে জয়লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা বাঙালীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে চায় না। উলটো তারা ১৯৭১ সালে বাঙালিদের বিরুদ্ধে ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা শুরু করে। এসময় জামাত-ই-ইসলামি ও মুসলিম লীগ সহ সকল ইসলামপন্থী দলগুলো পাকিস্তানিদের এই গণহত্যায় সাহায্য করে। তাদের সহযোগিতায় পাকিস্তানীরা প্রায় ৩২ লক্ষ বাঙালি হত্যা করে ,সাথে ধর্ষণ করে অন্তত ৪ লক্ষ বাঙালি নারিকে। এরপর ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর আমরা পেয়েছিলাম মুক্তির স্বাদ। একাত্তরে আমরা রক্ত দিয়েছিলাম সেক্যুলারিজম এর জন্য।

১৯৭২ এর অরিজিনাল সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতা হচ্ছে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি। বঙ্গবন্ধু শেষদিকে সোশ্যালিস্ট বাঙলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। তাই তিনি বাকশাল(বাঙলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ) নামে একটা রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়ে বাঙলাদেশ ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। কিন্তু সেনাবিদ্রোহে তার মৃত্যু হয় ১৯৭৫ এর আগস্টে। এরপর জিয়ায়ুর রহমান সংবিধান থেকে সেক্যুলারিজম তুলে দেয় এবং সংযুক্ত করে "সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস"। আবার স্বৈরশাসক এরশাদ ১৯৮৮ সালে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে। এসবের মাধ্যমেই বাঙলাদেশ ধর্মীয় সংঘাত ও সাম্প্রদায়িকতার দীর্ঘ রাস্তায় যাত্রা শুরু করেছিলো।

সংবিধান থেকে সেক্যুলারিজম তুলে দেয়া ছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির সাথেও ছিলো ব্যাপারটা সাংঘর্ষিক। ২০১০ সালে যদিও আদালত সেক্যুলারিজম সংবিধানে ফিরিয়ে এনেছে তথাপি বাঙলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম এখনো ইসলামই রয়ে গেছে। রাষ্ট্রধর্মসহীত একটা সেক্যুলার দেশ চিন্তা করা খুব একটা সহজ ব্যাপার না।

বাঙলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থান

বাঙলাদেশের প্রথম ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থান হয় জঙ্গি সংগঠন হুজির মাধ্যমে। আফগান যুদ্ধে একসময় এ দেশ থেকে অনেক মুজাহিদ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে আফগানিস্তান গমন করেছিলো। তারাই দেশে ফিরে ১৯৯২ সালে হুজি প্রতিষ্ঠা করে। তারা ওসামা বিন লাদেন ও সৌদি আরব কর্তৃক সরাসরি অর্থ পেত। বাঙলাদেশ ও ভারতে একাধিক হামলার পিছনে রয়েছে হুজি।

বিশ্ব প্রথম এদেশে উগ্র ইসলামপন্থীদের উপস্থিতি টের পায় যখন নারীবাদী লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে হত্যার জন্য ইসলামপন্থীরা ৫০০০ ডলার পুরস্কার ঘোষনা করে। এরপর ১৯৯৯ সালে উদীচীর একটা কনফারেন্সে ২ টা বোমা হামলা হয় এবং অন্তত ১০ জন নিহত হয়। সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার মধ্যে উল্লেখ্য ২০০৫ সালে জে এম বির সারা দেশে সিরিজ বোমা হামলা। তারা এক ঘন্টার ও কম সময়ে সমগ্র বাঙলাদেশে ৬৩ জেলায় ৪৫০ এর ও অধিক বোমা বিস্ফোরিত করে। ২০১৪ সালে বেশ কয়েকটা জঙ্গি সংগঠন "জিহাদ কাউন্সিল" গঠন করে আসাম, বাঙলাদেশ ও রাখাইন অঞ্চল নিয়ে ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠা করার জন্য। তারা মাদ্রাসা ছাত্র ও রোহিঙ্গা মুসলিমদের থেকে যোদ্ধাও সংগ্রহ করছে।

ব্লগার হত্যা

ইসলামপন্থীদের বেঁধে দেয়া এক অদৃশ্য লাইন ক্রসের চেষ্টা যারাই করেছে তাদের জন্য বাঙলাদেশ দিন দিন বিপদজনক হয়ে উঠছে। গত ২ বছরে অন্তত ১১ জন মুক্তমনা, সেক্যুলারিস্ট ব্লগার, লেখক নিহত হয়েছে তাদের হাতে।

সেক্যুলার শাহবাগ আন্দোলন চলার সময়ে ২০১৩ সালে ব্লগার রাজিব হায়দার মিরপুরে জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। এরপর ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বায়ো-ইঞ্জিনিয়ার অভিজিত রায় ও তার স্ত্রী বন্যা আহমেদ জঙ্গিদের দ্বারা আক্রমণণের স্বীকার হন। প্রতিভাবান লেখক অভিজিৎ রায় নিহত ও বন্যা আহমেদ মারাত্মক আহত হন। ঐ বছরের মার্চেই ২ জিহাদির হাতে নিহত হয় ওয়াশিকুর বাবু। 'যুক্তি'র সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাস জিহাদিদের আক্রমণে নিহত হন ২০১৫ এর মে মাসে। ব্লগার নীলকে হত্যা করা হয় ২০১৫ এর আগস্ট মাসে। এরপর এরকম আরো অসংখ্য মৌলবাদী হামলার স্বীকার হয় বাঙলাদেশ যার সর্বশেষ হচ্ছে গুলশান এটাক।


                                         


এসব হামলার পরে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদউজ্জামান খান উল্টো ব্লগার ,লেখকদের দোষ দিয়ে বলেছেন ধর্মীয় নেতাদের সমালোচনা করার অধিকার কারো নেই এবং নিহত ব্লগারদের লেখা তদন্তের কথাও জানান তিনি। নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবী করা একটা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে আপনি এরকম ভয়ংকর বক্তব্য আশা করতে পারেন না। বাঙলাদেশ মুক্তমনা লেখক,ব্লগারদের জন্য দিন দিন বিপদজনক হয়ে উঠছে। হামলা গুলোর প্যাটার্ন প্রায় একইরকম। তবে সবচেয়ে কষ্টদায়ক হচ্ছে হামলার পরে সরকারের এরকম নিকৃষ্ট বক্তব্য। যার ফলে গত কয়েক বছরে বাঙলাদেশে একের পর এক প্রগতিশীলদের উপরে হামলার ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে।

আমাদের করণীয়

এদেশের সরকার সবসময়েই মৌলবাদীদের সাথে আপোষ করেছে। বাঙলাদেশে মৌলবাদের উত্থানের জন্য আওয়ামী লীগ সহ সব প্রধান রাজনৈতিক দল ই দায়ী। বর্তমান সরকার শাহবাগে হামলা করে বলেছে ব্লগারেরা জাতিকে বিভক্ত করছে। পাশাপাশি তারা হেফাজাতকে ডোনেট করছে, তাদের সকল অন্যায় দাবী মেনে নিচ্ছে। কে এই হেফাজাত এ ইসলাম! একটা উগ্র ধর্মান্ধ দল যারা কিনা পুরো পৃথিবীর কাছে বাঙলাদেশকে একটি মধ্যযযুগীয় ধর্মান্ধ দেশ হিসেবে পরিচিত করিয়ে দিতে চায়।

তাই আমাদেরকে এখুনি রুখে দাঁড়াতে হবে লাখ শহীদের রক্তের মুূল্য দিতে। মুক্তমনা লেখকেরা কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে না, তারা শুধু একটা সুন্দর বাঙলাদেশ গড়তে চায়। আমাদেরকে সংগ্রাম করতে হবে হিন্দু মুসলিম পাশাপাশি অবস্থানের জন্য। আমাদের মনে রাখতে হবে বিশ্বাস যার যার, বাঙলাদেশ সবার।



সরকারের এখন দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যেসব ব্যাপারে সুপারিশ করতে চাই তা হল..

১/ দেশে জঙ্গি নেই সরকারের এরকম বক্তব্য দেয়া বন্ধ করতে হবে। সমস্যাটা মেনে নিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা প্রয়োজন। নিজে নিজে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবো এরকমটা ভাবা বোকামি ছাড়া কিছুই না।

২/মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে সেক্যুলার সাব্জেক্টগুলো পড়াতে হবে। তারা যেনো সব ধর্মের, মতের মানুষের ব্যাপারে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে বড় হতে পারে সে সুযোগ করে দিতে হবে।

৩/মাদ্রাসা ছাত্রদের জন্য যথেষ্ট চাকরি ক্ষেত্র সৃষ্টি করতে হবে।

৪/ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করতে হবে। ১৯৭১ এ দেশ স্বাধীনের পরে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিলো। সেখানে নিয়ে যেতে হবে দেশকে।


সর্বশেষে বলতে চাই, এখন বাঙলাদেশের ভবিষ্যৎ বেছে নেয়ার সময়। আমরা কি পাকিস্তানের মত একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র চাই নাকি প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ বাঙলাদেশ চাই। সময় চলে যাচ্ছে , আপনাকে আমাকে সবাইকে এখুনি আওয়াজ তুলতে হবে।



                                                                            আমার মাটি, আমার মা
                                                                               পাকিস্তান হবে না।
                                                                                    জয় বাঙলা।





0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন