আমার শিরায় জ্বলে আগুন,
রুদ্ধশ্বাসে পুড়তে চায়।
আমার চোখে ঝড়ো মিছিল,
শ্লোগানে বদ্ধ উপমায়।

মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৭

আদিবাসীদের নিয়ে কিছু প্রলাপ


আদিবাসী কি? খায় না মাথায় দেয়? 
কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় দখলদার জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বে যারা বসবাস করত এবং এখনও করে,যাদের নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি, রীতিনীতি রয়েছে তারাই মূলত আদিবাসী। তবে আদিবাসী শব্দটার সংজ্ঞা নিয়ে বাঙলাদেশই না শুধু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রয়েছে যথেষ্ট বিতর্ক। যারা আদিবাসীদের উপজাতি করে রাখতে চায় আসলে তারাই চায়না দেশে আদিবাসী বলে স্বীকৃত কেউ থাকুক। বাঙলাদেশের সংবিধানের দিকে তাকালে তাই এই প্রশ্নই জাগে আদিবাসী খায় না মাথায় দেয়?

 বাঙলাদেশে আদিবাসী 
বাঙলাদেশ সরকারের মতে,বাঙলাদেশে কোন আদিবাসী জনগোষ্ঠী নেই। তবে সরকার এর কথা আজকাল কেউ বিশ্বাস করে না তাই বলছি, বাংলাদেশে প্রায় ৪৫টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে। কিন্তু বুঝতেই পারছেন তাদের সাংবিধানিক কোনো স্বীকৃতি নেই।
আদিবাসী বলতে তাহলে কাদের বুঝাচ্ছি? তারা হচ্ছে, যারা এই মাটিতে সবার আগে এসেছে, চাষ করেছে এবং এই দুর্গম পাহাড়ি,শ্বাপদসংকুল পরিবেশে নিজেদের হাজার বছর টিকিয়ে রেখেছে। এইরকম জাতিদের মধ্যে রয়েছে, খিয়াং, খুমী, চাক, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা , সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও, কোচ, রাজবংশী, মণিপুরি, খাসী, ত্রিপুরা, লুসাই, বরিশালের রাখাইন সহ অন্তত ৪৫ টা জাতি। তারাই এই দেশে প্রথম এসেছে, তারাই কি তাহলে আদিবাসী নয়? 


আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে অবদান
নির্যাতনের দিক থেকে এদেশের আদিবাসীদের উপর নির্যাতনের মাত্রা কোন অংশে কম ছিল না পাকিস্তান আমলে। বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে প্রচুর আদিবাসী নারী ও পুরুষ মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে রক্ত ঝরায় প্রত্যেকটা আদিবাসীগোষ্ঠীর মানুষই।
একাত্তরে পাকিস্তান সেনা বাহিনী সাঁওতালদের হিন্দু হিসেবে গুনতো। তাই পাকিস্তানিদের অত্যাচারে বাঙলাদেশ থেকে ভারতে বিতারিত হইয়েছিল অন্তত ৩০,০০০ সাঁওতাল। তারা ভারতে গিয়ে বসে থাকেনি। প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসেছে দেশে,যুদ্ধ করেছে দেশকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচাতে। সেইসব সাঁওতালদের নেতা ছিলেন তখন আদিবাসী সাঁওতাল নেতা সাগরাম মাঝি। সাগররাম মাঝির অনুপ্রেরণাতেই সাওতালরা দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন এই সাগরাম মাঝি। জাতীয় ৪ নেতার একজন কামরুজ্জামানের রাজনৈতিক সহকর্মীও ছিলেন তিনি।


ঐ সময়ে সাঁওতাল বিশ্বনাথ টুডু ছিলেন একজন প্লাটুন কমান্ডার। ফাদার লুকাশ মারান্ডি ছিলেন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক। তিনি সাঁওতালদের যুদ্ধে নানাভাবে সাহায্য করতো সেজন্য তাকে পাকিস্তানিরা হত্যা করে একসময়। যুদ্ধের সময় রাজশাহীর গোদাগাড়ির সাঁওতালরা ছিলো মুক্তিযুদ্ধাদের আশ্রয় ও খাদ্যদাতা। তাই পাকিস্তানিরা গোদাদাড়িতে হামলা চালায় এবং হত্যা করে প্রচুর সাঁওতাল। ধর্ষিত হয় প্রচুর সাঁওতাল নারী।
এরকম বীরত্বপূর্ন অবদান রয়েছে আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধে। তাদের মধ্যে উল্লেখ্য কিছু যোদ্ধা হচ্ছেন, সাধন সিংহ, অনিতা সিনহা, বাণী সিনহা, নীলমনি চট্টোপাধ্যায়, নন্দেশ্বর সিংহ, বিজয় সিংহ, উ-মংয়াইন, উ-ক্যহ্রাচিং, উ-উসিতমং, রাজা মপ্রু, তাতিন্দ্রলাল চাকমা, রসময় চাকমা সহ অসংখ্যজন। 

 স্বাধীন বাঙলাদেশে আদিবাসীদের অবস্থা 
যে দেশে আদিবাসী বলতেই কিছু নেই সে দেশে আদিবাসীদের অবস্থা নিয়ে আলোচনা করা সহজ না। বাঙলাদেশে আদিবাসীদের সংখ্যা প্রায় ৩০ লক্ষের মত। আদিবাসীদের একটা বিশাল অংশ পাহাড়ি। তারা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এই তিন জেলাতেই বসবাস করে বেশিরভাগ।
স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু আদিবাসী নেতাদের বলেছিলেন,আমরা সবাই বাঙালি। তোমরা তোমাদের পরিচয় ভূলে যাও এবং বাঙালি হয়ে যাও। ১৯৭৩ এ তিনি রাঙ্গামাটিতে গিয়েও বলেন, তোরা সবাই বাঙ্গালি হইয়া যা। অথচ পাকিস্তানিরাও ঠিক একইভাবে আমরা বাঙালি বলে আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার নিকৃষ্টতম ব্যাবহার করেছিল এবং আমাদের উপরে একইভাবে তাদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলো। তাই আদিবাসীদের সাথেও ঠিক সেই কাজটাই করাটা ছিলো আমাদের আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক।

কিন্তু ১৯৭৯ এ জিয়াউর রহমান এই পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালি সেটেলার মুসলিমদের স্থানান্তরিত করে। এরপর থেকেই পাহাড়িদের জীবনে নেমে আসে আস্ত এক নরক। নিজ ভূমিতে পরবাসির মত বেঁচে আছে তারা। চরম খাদ্যের অভাব, বাঙ্গালী সেটেলারদের দ্বারা জোরপূর্বক ভূমি দখল,আদিবাসী নারীদের ধর্ষণ, হত্যা, ও আদিবাসীদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগানো, তাদের উচ্ছেদ করা এখন সেখানকার নিত্যনৈমত্যিক ব্যাপার।


সমতলের আদিবাসীদের ও একই হাল। এইতো কদিন আগেই সাঁওতালদের উপরে অমানবিক হামলা ও ভূমি দখলের কথা আমাদের সবার মনে আছে। 


পাহাড়ে এসব আদিবাসীবিরোধী কর্মকাণ্ডের পিছনে সবসময়ই থাকে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ। সেনাবাহিনী পাহাড়ে বাঙালি সেটলারদের নিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ১৩ থেকে ১৫ টা গণহত্যা চালিয়েছে। আর আদিবাসীদের উপর অত্যাচারতো নিত্যনৈমত্যিক ব্যাপার। পার্বত্য তিন জেলাকে মিলিটারি ক্যাম্প বানিয়ে রাখা হয়েছে। কল্পনা চাকমার সাথে যা ঘটেছিল সেটা আজ পাহাড়ের নিয়মিত ঘটনা।

কিছু পরিসংখ্যান থেকে ধারণা নেয়া যাক...... 




পরিসংখ্যানগুলো মাত্র ৭ বছর সময়কালের মধ্যে করা। আর এসবতো শুধু পরিসংখ্যানই, বাস্তব আরো ভয়াবহ।

 এর শেষ কোথায়? 
আদিবাসীদের এই করুণ অবস্থার জন্য দায়ী মূলত তাদেরকে আদিবাসী স্বীকৃতি না দেয়া। জাতিসংঘ অধিবেশনে দাঁড়িয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপুমনী বলেছিলেন, বাঙলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। জাতিসংঘের বাংলাদেশ মিশনের ফার্ষ্ট সেক্রেটারী ইকবাল আহমেদ ও বলেছেন, বাঙলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। তিনি আরো বলেন, এদেশে আদিবাসী খুঁজে যেনো জাতিসংঘ সময় নষ্ট না করে। অথচ বর্তমান হাসিনা সরকার যখন ২০০৮ এ তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে তখন সেখানে আদিবাসীদের স্বীকৃতি দেয়ার কথা উল্লেখ ছিলো। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর গণেশ উলটে গেলো! পরিসংখ্যান বলে কোনো সরকারের আমলেই আদিবাসীদের উপর অত্যাচার কম ছিলো না। পাকিস্তানির আমাদের সাথে যা করেছে আমাদের সেনাবাহিনী সেখানে যেনো তারই অনুকরণ করে চলেছে। একটা মানবিক বাঙলাদেশ গড়ার স্বপ্ন ততদিন সত্যি হবে না যতদিন না এই আদিবাসীদের উপর এই অমানবিকতা বন্ধ না হয়।
সংবিধানের ৬(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালি এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন। কথা হচ্ছে তাহলে সাগরাম মাঝিরা যুদ্ধ করেছিলো কি জন্য? তার থেকে বড় কথা এই ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী কি বাঙালি? তারা যদি চাকমা , মারমা বা গারো হয় তাহলে তারা কি বাঙলাদেশের নাগরিক না? আমরা কজন চাকমাদেরকে বাঙালি মনে করি? দেশটাকি তাহলে শুধু বাঙালিরই হলো! বাঙলাদেশ কি  এসব আদিবাসীগোষ্ঠীর না! আর আদিবাসী নির্যাতন বন্ধে আইন কি হবে না! সেনাবাহিনী কি আইনের ঊর্ধ্বে? আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে আমরা কবে সচেতন হব? তারা এভাবেই নির্যাতিত হয়ে যাবে আজীবন!  

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন