আমার শিরায় জ্বলে আগুন,
রুদ্ধশ্বাসে পুড়তে চায়।
আমার চোখে ঝড়ো মিছিল,
শ্লোগানে বদ্ধ উপমায়।

মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৭

ইরান-সৌদি দ্বন্দ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যে স্নায়ুযুদ্ধ


ইরান বনাম সৌদি আরব
ইসলামি প্রজাতন্ত্রী ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে রয়েছে দ্বন্দ্বের এক দীর্ঘকালীন ইতিহাস। ইসলামের ব্যাখ্যা, ইসলামিক জগতে নেতৃত্বের আঁকাঙ্খা, ভিন্ন তেল রপ্তানি নীতি, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিপরীতমুখী অবস্থানসহ নানা ভূ রাজনৈতিক কারণে ইরান ও সৌদি আরব পরস্পরের শত্রু হয়ে উঠেছে। যদিও ইরান ও সৌদি আরব উভয়ই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং ইসলামিক নীতি অনুসরণ করে দেশ পরিচালনা করে থাকে তথাপি বিশ্বাসের কিছু পার্থক্য এবং এসব ভূ রাজনৈতিক কারণে তাদের সম্পর্ক কখনই আর ভাল হয়ে উঠে নি।

সৌদি আরব একটি ডানপন্থী রক্ষণশীল সুন্নি ইসলামী রাষ্ট্র, যার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। অপরদিকে রাশিয়া ও চীনের সাথে ভাল সম্পর্কের সুবাদে এন্টি-ওয়েস্টার্ন বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে ইরান একটি শিয়া ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। এই শিয়া সুন্নি বিভেদ নিয়েই মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব দেয়ার এক প্রতিযোগিতায় নেমেছে এই দুদেশ, যা এই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতার পিছনে অন্যতম কারণ।

গত শতাব্দীর প্রথম থেকে এ দুই অঞ্চলের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। তবে শিয়া-সুন্নি বিভেদ ও ইরানের সাথে ইজরাইলের সম্পর্ক থাকায় ইরান-সৌদি সম্পর্ক তেমন ভাল হয়ে উঠেনি তখনো। ১৯৬৬ সালে সৌদি আরবের কিং ফয়সাল ইরানে আসেন সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য। এরপর ইসলামের উন্নয়ন ও ইসলামিক বিভিন্ন জোট প্রতিষ্ঠায় সৌদি আরবকে সাহায্য করে ইরান।

কিন্তু ষাটের দশকের শেষদিকে ইরানের শাহ সৌদির কিং ফয়সালকে সৌদি আরবকে আধুনিকায়ন করার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিং ফয়সালকে এক চিঠিতে শাহ লিখেন,"ভাই আপনি সৌদি আরবের আধুনিকায়ন করুণ। সৌদির মেয়েদের মিনিস্কার্ট পরতে দিন। ডিস্কো অনুমোদন করুণ এবং দেশকে মর্ডান করে গড়ে তুলুন। নইলে আমি নিশ্চয়তা দিতে পারছিনা আপনি কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন।" এতে কিং ফয়সাল কঠিন ভাষায় জবাব দিয়ে বলে,"শাহ, আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই আপনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নন। আপনার দেশের ৯০ ভাগ মুসলমান, দয়া করে ভুলে যাবেন না।"

১৯৬৮ থেকেই ইরানের সাথে সৌদির সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। দুদেশের মাঝে সত্তরের দশকে তেমন উত্তেজনা ছিলনা তবে ইরানের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নকে সৌদি আরব তখন থেকেই হুমকি হিসেবে দেখতে শুরু করে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর থেকেই ইরান একতরফাভাবে সৌদি আরবের বিরোধীতা শুরু করে। ইরান সৌদি আরবের সরকারকে ইসলামের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৮৭ সালে খোমেনি প্রকাশ্যে দাবী করেন,"সৌদির ওয়াহাবিরা নৃশংস,কুৎসিত তারা মুস্লিমদেরকে পিছন থেকে আঘাত করে যাচ্ছে।" এরপর সৌদি আরবের সাথে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয় ইরানের।

আবার ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া ইরান-ইরাক যুদ্ধে সৌদি আরব ইরাককে সমর্থন করে এবং ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ইরাককে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করে। পাশাপাশি কাতার, বাহরাইন, আরব আমিরাতকেও ইরাকে অর্থ পাঠানোর জন্য উতৎসাহিত করে সৌদি আরব। এর ফলে ইরান ক্ষেপে যায় এবং সৌদি আরবের আকাশসীমায় ফাইটার বিমান পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে আসে।
১৯৮৪ সালে ইরান সৌদিতে বিমান থেকে বোমাবর্ষন করে। ইরানের ৪ টি যুদ্ধবিমানের ৩ টিকে ধ্বংস করতে সক্ষম হলেও ৪র্থটি সৌদির আল-দাম্মাম শহরে হামলা করতে সফল হয়।

এদিকে ১৯৮৭ সালে হজ্বের সময় ইরানী হাজ্বীরা যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরাইলের বিপক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলে সৌদির সুন্নি পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। এ সময়ে ৪০০ এর ও বেশি হাজ্বীকে হত্যা করা হয়েছিল যার মধ্যে ২৭৫ জনই ছিল ইরানী। এ ঘটনার পর সৌদি ইরান সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে পৌঁছায়। এরপর সৌদি আরবের খোবার টাওয়ারে বোমা হামলা,রিয়াদের বোমা হামলা, সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত হত্যাচেষ্টার অভিযোগ, নিমর আল নিমর সহ বিশিষ্ট শিয়া নেতাদের মৃত্যুদন্ড দেয়াসহ আরো অনেক ছোট খাট বিষয় নিয়ে সবসময়ই আমরা সৌদি-ইরানের সম্পর্কের তিক্ততা উপলব্ধি করতে পেরেছি। 

তবে, বর্তমানে সৌদি-ইরান শত্রুতায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে রাশিয়ার পুনঃরায় পরাশক্তি হয়ে ওঠা এবং মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমাগত প্রভাব বিস্তার করতে থাকাটা গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে। সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ের দেশ অপরদিকে ইরান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের চিরশত্রু রাশিয়ার বলয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের আরেক শত্রু চীনের সাথেও দারুণ সম্পর্ক রয়েছে ইরানের।

সিরিয়া যুদ্ধে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদের সমর্থনে সবসময়ই সচেষ্ট ছিল ইরান। ২০১৫ সালে আসাদকে সহযোগিতা করতে সামরিক হস্তক্ষেপ করে পরাশক্তি রাশিয়া এবং রাশিয়ার বন্ধুরাষ্ট্র ইরান। অপরদিকে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে সৌদি সমর্থিত সুন্নি জঙ্গিগোষ্ঠি। সৌদি এবং যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট আইএসকে হঠিয়ে বাশার-আল-আসাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করছে ইরান। এ জন্য ইরান নিয়মিত আসাদকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য পাঠাচ্ছে।

আবার, ইরাকের বেশিরভাগ মানুষ শিয়া। ইরাকের শিয়া সরকার ও ইরানের কাছে তাই অনুগত। এটা নিয়ে সৌদি আরব উদ্বিগ্ন এবং ইরাকের সুন্নি জঙ্গি সংগঠনকে শিয়া সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অস্ত্র ও অর্থ সহযোগিতা করে যাচ্ছে ইরান।
তেল উৎপাদনের মাত্রা নিয়েও দু দেশের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে ইরানের সাথে রাশিয়ার বোঝাপড়া ভালো। একদিকে রাশিয়া চায় তেলের দাম বেশি থাকুক অপর দিকে যুক্তরাষ্ট্র চায় তেলের দাম কম থাকুক। আর এর প্রভাব এসে পরেছে এই দুই পরাশক্তির মিত্রদেশ সৌদি আরব ও ইরানেও।

ঐতিহাসিক দিক থেকে ইরানের সাথে সৌদি আরবের খারাপ সম্পর্ক বেশ পুরোনো। আরবরা আক্রমণ করে ফার্সি সভ্যতার বেশিরভাগ ধ্বংস করেছিল। সভ্যতার বিবেচনায় ইরানি সভ্যতা সবসময়ই আরব বেদুইনদের থেকে সহস্র ধাপ এগিয়ে ছিল। যার ফলে তাদের সভ্যতার উপর এরকম আঘাত ইরানিরা কখনো সহজভাবে নেয়নি। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ বাদ দিয়ে আধুনিক সময়ে চোখ রাখতে গিয়েও দেখেছি নানা ভূ রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে এই দু দেশের মধ্যে লেগেই রয়েছে একেরপর এক সংঘর্ষ, রণদামামা আর সৃষ্টি হচ্ছে আঞ্চলিক অস্থিরতা। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে চলমান এ সংঘাত কতদিন শুধু প্রক্সিযুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকবে সেটা ভাবাচ্ছে বিশ্বকে। তেলসমৃদ্ধ এ দুদেশের মাঝে চলমান কোল্ড ওয়্যার থেকে যদি ইরান-সৌদি যুদ্ধ লেগেই যায় তাহলে তার প্রভাব এরাতে পারবে না কোনো রাষ্ট্রই, ক্ষতিগ্রস্থ হবে প্রায় সমগ্র পৃথিবী।