আমার শিরায় জ্বলে আগুন,
রুদ্ধশ্বাসে পুড়তে চায়।
আমার চোখে ঝড়ো মিছিল,
শ্লোগানে বদ্ধ উপমায়।

মঙ্গলবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৭

ইতিহাসের এক বর্বরতম ঘটনা একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড


ডিসেম্বর ১৯৭১। পাকিস্তানিরা বুঝে গেলো তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তাই তারা তাদের বাকি থাকা সবচেয়ে ভয়াবহ কাজটা সম্পন্ন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। হ্যা, সেটাই ছিলো বাঙলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যা। "বাকি থাকা কাজ" এ জন্যেই বলছি কারণ এদেশের নির্দিষ্ট কিছু বুদ্ধিজীবী হত্যা করার পরিকল্পনা পাকিস্তানিদের আগে থেকেই ছিলো। যুদ্ধে হেরে যাওয়ার আগে শেষ কামড় দিয়েছিলো পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে। 

বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক ছিলো পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে এ হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করেছিলো  তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামস। কিন্তু কিভাবে এই হত্যাযজ্ঞটি শুরু হয়েছিল!! 

প্রথমে যে ব্যাপারটিতে নজর দেয়া যায় তা হলো, পরিকল্পনা মোতাবেক হত্যা করা বুদ্ধিজীবীদের সবাইই ছিলো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাবের জন্য সুপরিচিত। আল বদর বাহিনীর কাছে সব অধ্যাপক বা সাংবাদিকই এক ছিলো কিন্তু যারা এই বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা করেছিলো তাদের টার্গেট ছিলো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বুদ্ধিজীবীরাই।

ব্যাপারটি নিশ্চিৎ হওয়া যায় বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক রাও ফরমান আলীর ডায়রি থেকে। সেখান থেকে জানা যায় সি আই এ এজেন্ট  হেইট ও ডুসপিকের কথা। সি আই এ বুদ্ধিজীবীদের এই তালিকা তৈরি করে রাও ফরমান আলীকে নিয়ে। মুহাম্মদপুরের শারিরীক শিক্ষা কলেজটি ছিলো পাকিস্তানি ও মার্কিনী চক্রান্তকারীদের পরিকল্পনাস্থল। ১৪ ডিসেম্বর যেসব বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় তাদের প্রথমেই নিয়ে যাওয়া হয় এই শারিরীক শিক্ষা কলেজে।

বাঙলাদেশ স্বাধীন হয় ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। এরপর এই গণহত্যার তদন্ত করতে গঠন করা হয় "গণহত্যা তদন্ত কমিটি" যার সভাপতি ছিলো জহির রায়হান, যিনি নিজেও ছিলেন একজন প্রচণ্ড সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। স্বাধীন বাঙলার প্রথম গুম হওয়া ব্যক্তি হচ্ছেন জহির রায়হান। জহির রায়হানের হত্যার জন্য তার স্ত্রী সুমিতা দেবী রফিক নামে একজনকে দায়ী করেন। কিন্তু জহির রায়হান যেদিন গুম হন তারপরেই সেই রফিক পরিবারসহ আমেরিকা চলে যায়। তাকে জহির রায়হানের গুমের ব্যাপারে যেকোনো জবাবদিহিতা থেকে আজীবন যুক্তরাষ্ট্র রক্ষা করেছে।

১৯৭১ সালে ঠিক কতজন বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিলো তার সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। সি আই এ এর তালিকায় নাম ছিলো প্রায় ৩০০০ জন বুদ্ধিজীবীর। বলা হয়ে থাকে পাকিস্তানিরা যদি আর এক সপ্তাহ পরে আত্মসমর্পন করতো তাহলে তারা এই তালিকার সবাইকেই হত্যা করে ফেলতো। বাংলাপিডিয়া থেকে জানতে পারি পাকিস্তানিরা মোট বুদ্ধিজীবী হত্যা করতে পেরেছিল ৯৯১ জন। যদিও বাস্তবে আরো অধিক হবে সংখ্যাটা তা বলাই বাহুল্য। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন,

শহীদুল্লাহ কায়সার
নিজামুদ্দীন আহমেদ
সেলিনা পারভীন
সিরাজুদ্দীন হোসেন
আ ন ম গোলাম মুস্তফা
আলতাফ মাহমুদ
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত 
রণদাপ্রসাদ সাহা 
যোগেশ চন্দ্র ঘোষ
জহির রায়হান
নূতন চন্দ্র সিংহ
Intellectual Killing in Bangladesh 

বুদ্ধিজীবীদের বেশিরভাগেরই লাশ পাওয়া যায় নি। যাদের লাশ পাওয়া গেছে তার প্রায় সবগুলোই ছিলো নানা বদ্ধভূমিতে। মুক্তিযুদ্ধের এ পর্যন্ত ৯৯২ টি বদ্ধভূমি পাওয়া গেছে। তবে বুদ্ধিজীবীদের লাশগুলো পাওয়া যায় মুহাম্মদপুর, মিরপুর ও রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে। হত্যার আগে তাদেরকে ভয়ানকভাবে অত্যাচার করা হয়েছিলো। যন্ত্রণা দিতে দিতে একদম শে্ষ মুহুর্তে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিলো। বেশিরভাগকেই ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে হত্যা করা হয়েছিলো কাউকে কাউকে গুলি করে মারা হয়েছিলো। তাদের লাশগুলো দেখেই অত্যাচারের নির্মমতা বুঝা গিয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটা লাশ খুঁজে পাওয়ার কথা জানা যায় যার বর্ণনা ছিল এরকম "আর একটু এগিয়ে যেতেই বাঁ হাতের যে মাটির ঢিপিটি ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা। পরনে কালো ঢাকাই শাড়ী ছিল। এক পায়ে মোজা ছিল। মুখ ও নাকের কোন আকৃতি নেই। কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। মেয়েটি ফর্সা এবং স্বাস্থ্যবতী। স্তনের একটা অংশ কাটা। লাশটা চিৎহয়ে পড়ে আছে। বিভৎস চেহারার দৃশ্য বেশীক্ষণ দেখা যায়না। পরে অবশ্য সনাক্ত হয়েছে যে, মেয়েটি সাংবাদিক সেলিনা পারভীন। শিলালিপির এডিটর।



১৪ ডিসেম্বরকে বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করেন বাঙলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ। যেহেতু ১৯৭১ এর ১৪ ই ডিসেম্বর সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিলো তাই ১৪ ডিসেম্বরকেই বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ঢাকার রায়ের বাজারে নির্মিত হয়েছে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। এর স্থপতি হচ্ছেন মোস্তফা হালি কুদ্দুস। 

একটা দেশের এগিয়ে যাবার জন্য দরকার বুদ্ধিজীবীদের, তারাইতো জাতির পথপ্রদর্শক। একাত্তরের আমরা তাদের একটা বিশাল অংশ হারিয়েছি।  আজ বাঙালি এই স্মৃতিসৌধে এসে একাত্তরে সেসব বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগের কথা স্মরণ করে। এরকম হাজারো বুদ্ধিজীবী আমাদের মাঝে জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করেছিলো বলেই আমরা একাত্তরে যুদ্ধ করতে পেরেছিলাম। প্রফেসরদের জ্ঞানে, সাংবাদিকের লেখায় আর শিল্পীর গানে বাঙালি জাগ্রত হয়েছিলো একাত্তরে। সেইসব বুদ্ধিজীবীরা শুরু করেছিলো এক নতুন অভ্যুদয়ের, এক সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনার। যে চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই একাত্তরে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে বাঙালি। কিন্তু আমরা হারিয়ে ফেলি এদেশের সূর্যসন্তানদের। স্বাধীন বাঙলাদেশ তাদের ভুলে নাই। বুদ্ধিজীবী দিবসে সেইসব শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগের কথা প্রবল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে বাঙালি।

0 comments:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন